সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ || ৮ পৌষ ১৪৩১

Advertisement

দৈনিক বাংলা ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:৩৭, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

বাতাস থেকে সরাসরি পুষ্টি পেতে পারে মানবদেহ: গবেষণা

বাতাস থেকে সরাসরি পুষ্টি পেতে পারে মানবদেহ: গবেষণা
প্রতীকী ছবি

সুস্থভাবে জীবনযাপন করার জন্য দেহের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে হয়। সাধারণত পুষ্টির কথা ভাবলে মনে করি সবটুকুই খাদ্য থেকেই অর্জন করি আমরা। তবে এই ধারণাটি ভুল বলে ব্যাখ্যা করলেন বিজ্ঞানীরা। নতুন গবেষণায় বলা হয়, মানুষ কিছু পুষ্টি বায়ু থেকেও শোষণ করতে পারে!

এই নতুন গবেষণাটি ‘অ্যাডভান্সড ইন নিউট্রিশন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় শ্বাসের মাধ্যমে শোষিত পুষ্টিগুলোকে ‘অ্যারোনিউট্রিয়েন্টস’ বলে অভিহিত করা হয়। এগুলো গ্যাস্ট্রোনিউট্রিয়েন্টস থেকে ভিন্ন, যেগুলো অন্ত্রের মাধ্যমে শোষিত হয়।

খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান যেমন আয়োডিন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ এবং কিছু ভিটামিন শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে পারে। মানুষ প্রতিদিন প্রায় ৯ হাজার লিটার বায়ু শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং আর জীবনব্যাপী প্রায় ৪৩৮ মিলিয়ন লিটার বায়ু। জীবনের কোনো পর্যায়ে শ্বাস নেওয়া কখনোই থামে না। বায়ুর উপাদানগুলো এমনকি খুব ক্ষুদ্র ঘনত্বের হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো শরীরে প্রভাব ফেলতে পারে।

এ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুর প্রভাব নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণায় ‘দূষণ’–কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন গবেষণার মূল লক্ষ্য হচ্ছে—বায়ুর ক্ষতিকর উপাদানগুলো ফিল্টার করে, যা উপকারী হতে পারে তা খোঁজা। এ ছাড়া একটি একক শ্বাসে পুষ্টির পরিমাণ এত ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে কখনো একে গুরুত্বপূর্ণ বলে এর আগের গবেষণাগুলোয় মনে করা হয়নি।

বহু বছর ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিশুদ্ধ বাতাসকে স্বাস্থ্যকর হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। নতুন গবেষণাটি দেখায় যে, এই ধারণা বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত। উদাহরণস্বরূপ, অক্সিজেন একটি পুষ্টি উপাদান যা ‘শরীরের মৌলিক কার্যক্রম বজায় রাখতে প্রয়োজন’। তবে এটি খাওয়ার বদলে আমরা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি।

নাক, ফুসফুস, গন্ধ শনাক্তকরণের এলাকা (অলফ্যাকটরি এপিথেলিয়াম) এবং মুখগহ্বর এর রক্তনালীর সূক্ষ্ম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শোষিত হয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করে অ্যারোনিউট্রিয়েন্টস।

অন্ত্রের চেয়ে ২৬০ গুণ বড় আকারের অণু শোষণ করতে পারে ফুসফুস। এই অণুগুলো অক্ষত অবস্থায় রক্তপ্রবাহ এবং মস্তিষ্কে শোষিত হয়।

শ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া ড্রাগগুলো (যেমন কোকেইন, নিকোটিন) শরীরে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রবেশ করে। মুখে খাওয়ার বদলে শ্বাসের মাধ্যমে নেওয়ার ফলে এগুলো কম ঘনত্বেও বেশি কার্যকারী।

এ ছাড়া এনজাইম এবং অ্যাসিডের মাধ্যমে অন্ত্র বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থকে তাদের ক্ষুদ্রতম অংশে ভেঙে দেয়। একবার যখন এই উপাদানগুলো রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে, তখন সেগুলো লিভার বা যকৃতের মাধ্যমে বিপাক ও নির্বিষ হয়।

স্টার্চ, শর্করা এবং অ্যামিনো অ্যাসিড খুব দক্ষভাবে শোষণ করে অন্ত্র। তবে কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ শোষণে অন্ত্র ততটা দক্ষ নয়। মূলত, বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত এমন ওষুধ তৈরি করতে কাজ করছেন, যাতে সেগুলো কার্যকরভাবে মুখের মাধ্যমে গ্রহণ করা যায়।

১৯৬০-এর দশকের একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা কাপড় ধোয়ার পেশায় নিয়োজিত ছিল তারা অনেক বেশি আয়োডিনের সংস্পর্শে আসতেন। আর তাদের রক্ত এবং মূত্রে আয়োডিনের মাত্রা বেশি ছিল।

সম্প্রতি সাগরের শৈবাল সমৃদ্ধ উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী স্কুলগামী শিশুদের ওপর গবেষণা করেছেন আয়ারল্যান্ডের গবেষকেরা। সেই অঞ্চলে বায়ুতে আয়োডিন গ্যাসের স্তর অনেক বেশি ছিল। এই শিশুদের মূত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি আয়োডিন পাওয়া গেছে। অপরদিকে যারা কম শৈবালযুক্ত উপকূলীয় বা গ্রামীণ এলাকায় বাস করছিল তাদের মূত্রে আয়োডিনের মাত্রা কম ছিল। তবে উভয় অঞ্চলের শিশুরা যেসব খাদ্য গ্রহণ করত সেগুলোতে আয়োডিনের মাত্রা একই ছিল।

এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বায়ুতে থাকা আয়োডিন খাদ্য থেকে প্রাপ্ত আয়োডিনের পরিপূরক হতে পারে। বিশেষ করে যেখানে প্রচুর শৈবাল রয়েছে। এ কারণে এটি একটি অ্যারোনিউট্রিয়েন্ট হতে পারে, যা মানুষের শরীর শ্বাসের মাধ্যমে শোষণ করতে পারে।

নাকে গন্ধ শনাক্তকারী নিউরনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে ম্যাঙ্গানিজ এবং জিংক। ম্যাঙ্গানিজ একটি অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান। তবে বেশি মাত্রার ম্যাঙ্গানিজ মস্তিষ্কে ক্ষতি করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, ঝালাইয়ের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বায়ুর মাধ্যমে উচ্চ মাত্রার ম্যাঙ্গানিজের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের শরীরে ম্যাঙ্গানিজের ক্ষতিকর স্তরে জমা হয়।

অলফ্যাকটরি বা ঘাণতন্ত্র এবং শ্বাসযন্ত্রে সিলিয়া (চুলের মতো কাঠামো) বিশেষ রিসেপটর ধারণ করে, যা বিভিন্ন সম্ভাব্য অ্যারোনিউট্রিয়েন্টসের শোষণ করতে পারে। যেমন কোলিন, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, লোহা এবং এমনকি অ্যামিনো অ্যাসিড।

৭০ বছরেরও বেশি আগে প্রকাশিত একটি গবেষণা দেখা যায়, অ্যারোসোল বা ক্ষুদ্র কণা আকারে ভিটামিন বি১২ শ্বাসের মাধ্যমে শোষণ করা যেতে পারে এবং এটি ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি চিকিৎসায় কার্যকর। বিশেষভাবে মানুষ, ডায়াবেটিস রোগী এবং অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের ভিটামিন বি১২ চিকিৎসার জন্য এই প্রক্রিয়াটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যারোনিউট্রিয়েন্টস নিয়ে এখনো তথ্য অজানা। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বন, সাগর এবং পার্বত্য অঞ্চলে বায়ুর কোন উপাদানগুলো স্বাস্থ্যকর তা প্রথমত জানতে হবে। এখন পর্যন্ত শুধু বায়ুর বিষাক্ত পদার্থ, বিভিন্ন উপাদান এবং এলার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী পদার্থ যেমন পোলেন বা রেণু নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।

এরপর কোন কোন উপাদানকে অ্যারোনিউট্রিয়েন্টস হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করতে হবে। ভিটামিন বি১২ অ্যারোসোল আকারে নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস, যেমন ভিটামিন ডি অ্যারোসোল আকারে ব্যবহার করে পুষ্টির ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।

এই সম্ভাব্য অ্যারোনিউট্রিয়েন্টসগুলোকে নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশে পরীক্ষা করতে হবে। এর ফলে এগুলো ডোজ, নিরাপত্তা এবং খাদ্যতালিকায় অবদান নির্ধারণ করা যাবে। বিশেষভাবে এসব তথ্য এমন জায়গাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেখানে বায়ু উচ্চমাত্রায় ফিল্টার করা হয়। যেমন বিমান, হাসপাতাল, সাবমেরিন এবং মহাকাশ স্টেশন।

অন্যদিকে, অ্যারোনিউট্রিয়েন্টস শহুরে রোগগুলো প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। একদিন হয়তো সুস্থতার জন্য সুষম খাদ্যের পাশাপাশি অ্যারোনিউট্রিয়েন্টসও গ্রহণের জন্যও চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেবে।

তথ্যসূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট