রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বিপজ্জনক
আবারও মিয়ানমার থেকে এক শ্রেণির দালাল চক্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা চোরাইপথে কৌশলে এবং পথে পথে টাকা-পয়সা দিয়ে বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রেখেছে যা দেখার কেউ নেই। যদিও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়া নজরদারি থাকার পরও এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজারের ওপরে রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে ঢুকে পড়েছে। আরও ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
বিজিবি ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইতোমধ্যে প্রতি রাতে যে হারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। পুনরায় গণহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনায় স্থানীয়রা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে বর্ডারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট অবহেলা ও উদাসীনতা কাজ করছে। রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে আর বিজিবি কোস্টগার্ড এদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একের পর ব্যর্থতায় পরিচয় দিয়ে আসছে।
বিষয়গুলো শুধু তদন্ত নয়, গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো উচিত। দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে সেনা-নৌবাহিনীর মোবাইল টহল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এ পর্যন্ত এক লাখের অধিক রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ এখন অনেক নিরাপওা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে দালালদের পাকরাও বা তাদের দমনের ব্যাপারে বিজিবির কোনো উদ্যোগ নেই।
সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আগমন প্রতিরোধ করার জন্য বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নজরদারি না বাড়ালে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বিপদের মধ্যে পড়তে পারে নইলে এক সময় সাড়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বিচরণ রোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন। এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পাশে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে পারছে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে উদাসীনতা প্রদর্শন করছে। সীমিত অবকাঠামো এবং সংস্থাসহ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উপচেপড়া ভিড়, যা পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। উদ্বাস্তুরা বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন এবং পরিষেবার অ্যাক্সেসসহ গুরুতর মানবিক প্রয়োজনের মুখোমুখি হচ্ছে। শিবিরগুলোতে প্রায়শই অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া ক্যাম্পে নিরাপওা সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। সহিংসতা এবং মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনাও ঘটছে অহরহ, যা ইতোমধ্যেই কঠিন জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলছে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
সাত বছর পূর্বে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার কর্তৃক গণহত্যা ও নির্যাতনের প্ররিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কোনো লক্ষ্যই দেখা যাচ্ছে না বা আদৌ দেখা যাবে কি না, তাও সন্দিহান। জাতিসংঘসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অনুরোধে তৎকালীন সরকার মানবিক দৃষ্টিতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের শুধু আশ্রয় নয়, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে প্রবল ছিলেন তারা এক এক করে ইতোমধ্যে সরে পড়েছেন। মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমানায় একের পর এক মর্টার, গোলাবারুদ ও গুলি ছুড়েছে যা চলমান। এই মানবিক কাজে সরকার চাহিদা মোতাবেক তেমন কোনো বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে না। বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এতে বাংলাদেশ হুমকির মধ্যে পড়েছে। মাদক, অস্ত্র, মদ, ইয়াবার ঘাঁটি হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এরপর অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে বগিরাগতদের আগমন বিপজ্জনক।
মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বর্তমানে নিরাপদ স্থান। এতে স্থানীয় প্রশাসন বিব্রত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এরপর কিছু দেশি-বিদেশি এনজিওদের কর্মকাণ্ডে সরকার ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন অপরাধে অনেক রোহিঙ্গা আটকও হয়েছে। চীন ও ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ আদৌ রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসন করতে পারবে কি? রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন শুধু বিপদে নয়, নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
ইতোমধ্যে ভারত থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, এই অবস্থায় শুধু রোহিঙ্গা কেন ভারত থেকেও অনেক নাগরিক বাংলাদেশে চলে এসেছে। দীর্ঘদিন থেকে কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতে বাংলাদেশ বিড়ম্বনা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে, তারপর যদি ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়, এটা ঠিক নয়। বিহারি বা পাকিস্তানিদের এখন পর্যন্ত সে দেশে প্রত্যাবর্তন করা হয়ে ওঠেনি তদরূপ রোহিঙ্গাদেরও আর কোনোদিন মিয়ানমারে পাঠানো সম্ভব হবে কি না সন্দিহান। এটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি নতুন বোঝা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সংকট সমাধানে চীন ও ভারত এগিয়ে না আসাটাও বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সর্বত্র প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যটন জেলাটি আজ রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যুদস্ত। এ জেলার উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। কক্সবাজার জেলার সমুদ্রসৈকত এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসন বা সরকার সমুদ্রসৈকতটি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট লিজ দিতে পারে। অপরিকল্পিতভাবে যে হারে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় হোটেল, রিসোর্ট ও বাড়িঘর নির্মাণ হয়েছে তার কোনো বৈধতা নেই। আশা করি, ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে সরকার এবার রোহিঙ্গাদের নিশ্চয়ই মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবে। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) হাইকমিশনার আগামীতে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা বিপজ্জনক হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নতুন করে ইউক্রেন ও আফগানিস্তান সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের তহবিল পর্যাপ্ত নাও পেতে পারি। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও এডিপির সহযোগিতা রড়ই প্রয়োজন।
ইউএনএইচসিআর মনে করে যে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে আগামীতে ফেরত পাঠানোর বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই অনুকূলে নয়। তৎকালীন আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন দেশটিকে মহাবিপদে ফেলে দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে চীন, ভারত ও জাপানের সহযোগিতার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজকে কাজে লাগাতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সূত্র: দৈনিক বাংলা