ইসলামের আলোকে মাজার প্রথা
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত নতুন স্বাধীনতার স্বপ্ন-স্বাদ জাতির ভাগ্যে জড়ানোর জন্য যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে, তখন অনেক অপরিণামদর্শীর মতো আমাদের ইসলাম ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠীও তাদের মতবাদ বাস্তবায়নের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় বিচারে ওরা যেই তরিকারই হোক কাজটা অপরাধমূলক এবং নিন্দনীয়ও। প্রসঙ্গটা সাম্প্রতিক দেশ জুড়ে ওলি-আওলিয়াদের মাজার ভাঙা। দুঃখজনক হলেও সত্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর (পুলিশ-আনসার) নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এই অরাজকতার মাত্রাটা লাগামহীনভাবে ছড়াচ্ছে। এর ফলে পবিত্র মাজার ও সংযুক্ত উপাসনালয়গুলো যেমন ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অসম্মানিত হচ্ছেন আমাদের ধর্ম প্রচারের জন্য আসা ওলিগণ। মহান আল্লাহ মনোনীত ধর্ম ইসলামও হচ্ছে বিতর্কিত।
ওরা কারা যারা মাজার ভাঙার কাজটি বেশ সাহসিকতার সাথে করছেন আর এর স্বপক্ষে কি যুক্তি বা কোরআন-হাদিসের সমর্থন তাদের আছে? প্রশ্নটি সবার। এই বিষয়ে বা এর পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলতে গেলে ইসলামের কিছু মতবাদ ও ধর্মীয় তত্ত্ব আমাদের জানা দরকার।
মাজারের ধারণা ও পরিবর্তিত প্রথা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার একটি বৈচিত্র্যময় ও স্পর্শকাতর বিষয়। এটি কেবল ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা, সুফিবাদ এবং ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে জড়িত নয় বরং মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আজকের আলোচনায় এই মাজারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, মর্যাদা এবং মাজার ভেঙে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু আলোকপাত করব ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে। আশা করি যাদের এ বিষয়ে জানার অস্পষ্টতা রয়েছে, মহান আল্লাহ তাঁদের সত্যটা বোঝার তৈফিক দান করবেন।
ইসলামের সূচনালগ্নে অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকালে মাজার প্রথা অর্থাৎ কবরের ওপর কাঠামো নির্মাণ বা এটাকে ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হতো না। তবে ইসলামের প্রসার ও মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম প্রচারক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করার প্রবণতা থেকে মাজার প্রথার প্রচলন শুরু হয়। বিশেষত উমাইয়া ও আব্বাসিয়া খেলাফতের সময় ইসলামি স্থাপত্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পীর-আওলিয়াদের কবরের ওপর নান্দনিক মসজিদ ও আচ্ছাদন নির্মাণের রেওয়াজ শুরু হয়। এই সময় মসজিদের পাশে বা ভেতরে পীর-আওলিয়াদের কবর দেওয়া হতো এবং স্থানটিকে ধর্মীয় শ্রদ্ধার প্রতীকে পরিণত করা হতো।
ইরাকের কারবালায় হজরত ইমাম হোসেন (র.), বাগদাদের বড় পীর হজরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.), ভারতের হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র.), হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিস্তি (র.), বাংলাদেশের সিলেটের হজরত শাহজালাল (র.), হজরত শাহপরান (র.), হবিগঞ্জের মুরারবন্দে হজরত শাহ সৈয়দ নাসির উদ্দীন (র.), হজরত শাহ বোগদাদী (র.) এবং বাগেরহাটের হজরত খান জাহান আলী (র.), চট্টগ্রামের হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজার সহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য প্রসিদ্ধ মুসলিম ধর্মপ্রচারক, সুফী-সাধকদের কবর রয়েছে, যেগুলো ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শত শত বছর ধরে টিকে আছে। আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশে বাগদাদকেন্দ্রিক মুসলিম খেলাফত এবং পরবর্তীতে মোগল সাম্রাজ্যের যুগ থেকে সুফী মতবাদের বিকাশ ঘটে। যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিক ভাবধারায় পরিচালনা এবং চর্চা করতেন। এই সুফিবাদীরাই মূলতঃ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও পিঠস্থানগুলোকে সম্মান করতেন এবং এগুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের ধর্মচর্চা এবং প্রচার-প্রসারের কাজ পরিচালনা করতেন। সাধারণ মুসলমান উনাদের কথা, আচরণ ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে লাগলেন। সম্মানিত হতে থাকল মাজার বা ধর্মীয় স্মৃতিস্থানগুলো।
কালক্রমে এগুলো ধর্মীয় সহনশীলতা, মর্যাদা ও আধ্যাত্মিকতার একটি প্রতীকে পরিণত হওয়ায় লক্ষ কোটি ভক্তকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। ইরানে মাজার প্রথা ইসলামি বিপ্লবের পূর্বেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ইমামদের মাজারগুলো আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে মাজারের বৈধতা: মাজার জিয়ারত এবং প্রার্থনা করার বৈধতা নিয়ে ইসলামে মতভেদের অভাব নেই। সুফিবাদীরা মাজার জিয়ারত ও ওলি আল্লাহদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষণ মনে করে।
পক্ষান্তরে ওহাবী, সালাফী ও আরও কিছু মতাবলম্বী মাজার জিয়ারত ও পীরদের প্রতি আনুগত্য বা অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনকে শিরক হিসেবে গণ্য করে। পবিত্র কোরআনের সুরা আন-নিসার (আয়াত ৪:৪৮) নির্দেশনা হলো মহান আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শিরককে ক্ষমা করেন না। তবে তিনি তার ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য যেকোনো পাপ ক্ষমা করবেন।’ এই আয়াত অনুসারে সালাফী ও ওহাবীরা মনে করেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর কাছে প্রার্থনা করা বা কারোর কবরের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থি। সালাফী বা ওহাবীরা তাদের মতবাদের স্বপক্ষে যে হাদিসটি বর্ণনা করেন, তা হলো সহি বুখারী শরীফের ৪২৮ নং হাদিস। যেখানে রাসুল (সা.) মদিনায় এক উচ্চস্থানে উপনীত হয়ে নামাজের স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে বনি নাজ্জার গোত্রের নেতাদের উপস্থিতিতে সাহাবাদে নির্দেশ দিয়েছেন সব উঁচু টিলা ও উঁচু কবর ভেঙে সমান করে দিতে। এই হাদিসের সূত্র ধরে মাজার প্রথার বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান শত শত বছর ধরে। এই মতাবলম্বীরা এর পটভূমি বা প্রেক্ষাপটে না গিয়ে এর মধ্যে তারা অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে রাজি নন। তাঁদের এই বিরোধিতার পেছনে আরও যেসব কার্যকারণ কাজ করে, তাহলো মাজার বা পীরদের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে ইসলামী সমাজে নানান রকম বিতর্ক ও সমালোচনা বিদ্যমান। যা পরস্পরের সম্পর্ক ও ইসলামি ঐক্যকে বিনষ্ট করছে। মাজারগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা, নেশা দ্রব্য বিক্রি, ব্যবহার, নাচ-গান ও অতিরিক্ত ভক্তি প্রসূত পীরদের পায়ে সেজদা/চুমু খাওয়ার মতো অসামাজিক ও বেদায়াতী কর্মকাণ্ড ঘটছে- যা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাই এই প্রথাকে যদি উৎসাহিত করা হয়, তা হলে সমাজে শিরক ও পাপকর্ম বৃদ্ধি পাবে। সেজন্য এই প্রথার বিলোপ সাধনে তারা বদ্ধ পরিকর।
মাজার প্রথা বিরোধীদের কথায় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও যুক্তি যথেষ্ট জোরালো থাকলেও সাধারণ সব মুসলিম ও মাজারপন্থিরা মনে করেন মানুষের মাঝে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম প্রচারক পীর-ওলিদের জীবনাদর্শ প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার জন্য ওনাদের কবরস্থানগুলোকে বিশেষ আদব দেখানোর প্রয়োজন আছে। এই মতাবলম্বীরা আরও বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের শেষ নবীর ইন্তেকালের পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বটা উম্মতে মোহাম্মদীর স্কন্ধে বর্তায়। আর এই পবিত্র দায়িত্বটা অনেক ত্যাগ আর ধৈর্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী যারা প্রতিপালন করেছেন তারাই আল্লাহর প্রকৃত প্রিয় বান্দা বা ওলী। আজকের বিশ্ববিস্তৃত ইসলামী জগৎ তাদেরই ত্যাগ ও অবদানের ফসল। কাজেই উনাদের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করার মধ্যে বেদাত বা শিরক বলতে কিছু নেই। দ্বীনের খেদমতে উনারা ছিলেন পরীক্ষিত এবং পরহেজগার। অতএব ওলী-আল্লাহর উছিলায় আল্লাহ আমাদের হেদায়েত করবেন- এই বিশ্বাসটুকুই মাজারপন্থিদের সবচেয়ে বড় বুনিয়াদ। তাই এই পন্থিরা ওলী-আল্লাহদের কবর বা মাজারকে অসম্মান করতে চান না।
এই মতাবলম্বীরা মনে করেন যে, হাদিস বা দলিলের ভিত্তিতে মাজার বিরোধীরা তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন, সেখানে যথেষ্ট বোঝার ভুল রয়েছে। তারা সহি বুখারী শরীফের রাসুল (সা.)-এর উঁচু কবর ও টিলা ভাঙার নির্দেশনাটির পটভূমি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনেননি। রাসুল (সা.) কোন পরিস্থিতিতে উক্ত নির্দেশনাটি সাহাবাদের দিয়েছিলেন তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না। সেজন্য সহি বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসটির বিষদ ব্যাখ্যা নিম্নে দেওয়া হলো :
হজরত আনাস বিন মালিক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) মদিনায় এক উঁচু এলাকায় এলেন। যাকে ইবনুল আউফ গোত্রের মহল্লা বলা হয়। সেখানে তিনি ১৪ রাত্রি অবস্থান করলেন। তারপর তিনি নাজ্জার গোত্রের নেতাদে খবর পাঠালেন। তারা তরবারী ঝুলিয়ে উপস্থিত হলেন। নবী (সা.) আবু আয়ুবের গৃহ প্রাঙ্গণে অবস্থান করলেন। আনাস (র.) বলেন- রাসুল (সা.) যেখানে সালাতের ওয়াক্ত হতো, তিনি সেখানেই সালাত আদায় করতেন। হোক সেটা বকরি, ভেড়া বা উটের বসতঘর। তখন তিনি নাজ্জার গোত্রের প্রধানদের উপস্থিতিতে বললেন- হে নাজ্জার! তোমরা এই বাগানখানি আমার নিকট বিক্রি করো। তারা বললেন, আল্লাহর কসম আমরা এর মূল্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাই। আনাস (রা.) বললেন, এই বাগানটিতে কী ছিল, আমি বলছি: এখানে ছিল খেজুর গাছ, মুশরিকদের কবর আর পুরাতন ঘরদুয়ারের ভগ্নাবশেষ। তখন রাসুল (সা.) সেখানে মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিলেন এবং তাঁর নির্দেশে খেজুর গাছ কেটে দেওয়া হলো। কবরগুলো খুঁড়ে ফেলা হলো এবং ধ্বংসাবশেষ সমান করে ফেলা হলো। আনাস (রা.) বললেন তারপর কিবলার দিকে খেজুর গাছের সারিবদ্ধ থাম দেওয়া হলো এবং দুই পাশে পাথর স্থাপন করা হলো (সহী বুখারী-৪১৬)। উল্লেখিত হাদিসের বরাতে সুফিবাদীদের মতামত হলো: কবর ভেঙে সমান করার হাদিস মুসলমানদের কবরের ক্ষেত্রে নয়। মুশরিকদের কবরের জন্য প্রযোজ্য।
অতএব এ বিষয়ে আর কোনো বিতর্ক বা আলোচনা না বাড়িয়ে আমরা সাধারণ মুসলমানগণ মনে করি যে, আমাদের বিশ্বাস আর আমলের ভিত্তি যদি হয় কোরআন-হাদিস, তাহলে এ বিষয়ে এসবের বাইরে কোনো মতামত বা যুক্তিকে অন্তরে ঠাঁই দেওয়া ঈমানের পরিপন্থি। মাজার সমাজে কোনো অশান্তি বা বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে না। মাজারকে পাপকর্মের কেন্দ্র বানিয়ে তুলছে কিছু ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ ও অতিভক্তির ব্যক্তিগণ। মাজার যদি ইসলাম প্রচার, মুসলিম ঐক্য সৃষ্টিতে সহায়ক হয়, তাহলে সেটির বিরুদ্ধে ঝান্ডা উড়ানো অনুচিত। তবে সেই মাজার বা কবর হতে হবে পরীক্ষিত ও সত্যিকার আল্লাহর ওলীদের। যেকোনো ব্যক্তির কবরকে আলিশান দালানে রেখে লালশালু বা বেলভেট কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিলেই সেটি সম্মানের প্রতীক হতে পারে না। পক্ষান্তরে মাজারে যদি ধর্মকথা ও ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে শুধু নাচ-গান, নেশাদ্রব্য সেবন-বিক্রি আর পীরবাবা বা কবরকে সেজদা করার জায়গা হয়, তাহলে সেগুলোর বিরুদ্ধে অবশ্যই জনমত তৈরি করে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলা ও ফেতনা তৈরি করে নয়।
ইসলাম শান্তি ও মর্যাদার ধর্ম। পারস্পরিক ঐক্য বিনষ্ট করে কোনো মতবাদ চাপিয়ে দিতে গেলে ক্ষতি হয় আমাদের প্রিয় ইসলাম ধর্মের। এই সুযোগে ইসলাম বিরোধীরা আমাদের নিয়ে বিতর্ক তৈরির সুযোগ পায়। তাই ইসলামকে সব সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। মহান আল্লাহ আমাদের কোরআন ও হাদিসের আলোকে সব সংকট সমাধানের তৈফিক দিন। আমিন!
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ
সূত্র: দৈনিক বাংলা